খেতে লাগানো টমেটোর চারা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চাষিদের স্বপ্ন মাটিতে মিশে গেছে। লোকসানের মুখে পড়ে ও আয়ের উৎস হারিয়ে হতাশায় ভুগছেন টমেটো চাষিরা।
ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের কাছে সহযোগিতার দাবি জানিয়ে টমেটো চাষিরা অভিযোগ করে বলেন, ঘুর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানার ১০ দিন পরেও কৃষি বিভাগের কোনো কর্মকর্তা তাদের টমেটো খেত পরিদর্শন করতে আসেনি।
সোমবার বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলার চরবানিয়ারী, পশ্চিমপাড়া, কৃষ্ণনগর, গরীবপুর, বাওয়ালীপাড়া, দক্ষিণপাড়া, সন্তোষপুর, খড়মখালী, উমাজুড়ি এবং ডাকাতিয়াসহ বিভিন্ন কৃষি মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মৎস্য ঘেরের দুই পাড়ে সারিবদ্ধ করে রোপন করা টমেটো গাছ মরে যাওয়ায় গাছের সবুজ পাতা শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে আছে। ঝড়ের তাণ্ডব আর বৃষ্টির পানি সহ্য করতে না পেরে ফুলে-ফলে ভরা টমেটো গাছ মরে গেছে। মরা গাছের ডালপালা ঝুলছে বেড়ায়।
মরা গাছের কোনো কোনোটিতে ছোট-বড় আকারের টমেটো ঝুলছে। প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে ওই টমেটোও বিবর্ণ হয়ে আছে। এলাকাজুড়ে যতদূর চোখ যায় সব মৎস্যঘেরের পাশে টমেটো গাছ মরার চিত্র প্রায় একই রকম। এর পরেও শেষ মুহূর্তেও কোনো কোনো চাষি মরা টমেটো গাছ বাঁচানোর চেষ্টা করে চলেছেন।
টমেটো চাষিরা এই প্রতিবেদকের কাছে তাদের হতাশার কথা জানিয়ে বলেন, বেশি দাম পাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে বাগেরহাটের চিতলমারী, কচুয়া এবং ফকিরহাট উপজেলার চাষিরা শীত মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই টমেটোর চাষ করে আসছেন। এ এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা টমেটো রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। অনেক লাভজনক হওয়ায় চাষিরাও ঝুঁকে পড়েছেন আগাম টমেটো চাষে। অধিক লাভের আশায় কোনো কোনো চাষি এবছর বাড়িয়েও ছিলেন টমেটোর আবাদ।
নজরকাড়া বাহারি নামের লাভলী, বিউটি-১, বিউটি-২,পানপাতা, হাইটম, বিউটিফুল, বিপুল প্লাস হাইব্রিড এবং স্থানীয় জাতের টমেটো চাষ করা হয়েছে বাগেরহাটে। এই জাতের টমেটো ফল বেশি হয় এবং শীত মৌসুম শুরু হওয়ার আগে তা বাজারে বিক্রি করা যায়। আগাম ফলনের কারণে অধিক লাভের আশায় গত কয়েক বছর ধরে জেলার মধ্যে চিতলমারী উপজেলার চাষিরা অধিক পরিমাণ জমিতে টমেটো চাষ করে আসছে বলে কৃষি বিভাগ জানান।
চিতলমারী উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের চাষি চিত্তরঞ্জণ বসু জানান, গত বছর টমেটো চাষ করে কয়েক লাখ টাকা বিক্রি করেছেন তিনি। এবছর ধার-দেনা করে দুই লাখ টাকা ব্যয় করে ২৫ বিঘা জমিতে হাইব্রিড জাতের বিভিন্ন নামে টমেটো চাষ করেছেন। টমেটো গাছও অনেক ভালো হয়েছিল। সব মিলে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকার টমেটো বিক্রি করা যেত। কিন্তু বুলবুলের তাণ্ডবে সব টমেটো গাছ মরে শুকিয়ে গেছে। এখন ধার-দেনা কীভাবে পরিশোধ করবেন তা নিয়ে দুরচিন্তায় আছেন এ চাষি।
গরীবপুর গ্রামের আরেক চাষি অনিমেষ রায় বলেন, ‘মৎস্যঘেরের পাড়ের ১৫ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেছি। টমেটো গাছে ফুল আর টমেটোতে ভরপুর ছিল। বুলবুল আঘাত হানার এক সপ্তাহ আগেও কিছু কাঁচা টমেটো বিক্রি করেছি। এখন থেকে বাজারে পুরোদোমে কাঁচা-পাকা টমেটো বিক্রি করা যেত। কিন্তু ঝড়ের তাণ্ডব আর বৃষ্টির পানিতে গাছ মরে শুকিয়ে গেছে। আমার লাখ লাখ টাকার টমেটো বিক্রির স্বপ্ন মাটিতে মিশে গেছে।’
টমেটো চাষি বাবলু বসু জানান, গত বছর শুধুমাত্র চিতলমারী উপজেলা থেকে ২০০ কোটি টাকার উপরে টমেটো বিক্রি হয়েছে। টমেটো গাছে ফুল-ফল ভালো ধরায় এবছর ২২০ কোটির মতো টমেটো বিক্রি করা যেত। কিন্তু বুলবুল সব শেষ করে দিয়েছে।
এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত সব টমেটো চাষিদের অবস্থা প্রায় একই রকম জানিয়ে এসব চাষিরা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রকারের কাছে সাহয্যের দাবি জানিয়েছেন।
চাষিরা জানান, হাইব্রিড জাতের টমেটোর চারা ভাদ্র মাসের ১৫ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে রোপন করা হয়। চারা রোপনের পর থেকে ৬০ থেকে ৭০ দিন পর টমেটো বিক্রি করা যায়। গাছে টমেটো ধরার পর ঠিকমতো পরিচর্চা করলে একটানা তিম মাস পর্যন্ত টমেটো বিক্রি করা যায়। একটি গাছে গড়ে ছয় থেকে সাত কেজি টমেটো হয়। প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার টমেটো বিক্রি করা যায়। এক বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করতে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। বিঘা প্রতি জমির টমেটো প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়।
বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অসিম কুমার দাস জানান, চিতলমারী উপজেলায় ১৬ হাজার টমেটো চাষি রয়েছে। এই উপজেলায় এবছর ৪ হাজার ৩৫০ বিঘা জমিতে হাইব্রিড সাতটি জাতসহ আটটি জাতের টমেটো চাষ করা হয়েছে। ঝড়ে শুধুমাত্র চিতলমারী উপজেলার ৩ হাজার বিঘা জমির টমেটো সম্পূর্ণ ক্ষতি হয়েছে।
উপজেলা পরিষদ থেকে চিতলমারীর ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের জন্য ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এবছর টমেটোর উৎপাদন ধরা হয়েছিল একর প্রতি ১৩ থেকে ১৪ মেট্রিক টন। গত বছর শুধুমাত্র চিতলমারী উপজেলায় এক হাজার ৬৫৫ একর জমিতে ২২ হাজার ৭৮০ মেট্রিক টন টমেটো উৎপাদন হয়েছে।
বাগেরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ডিডি) রঘুনাথ কর জানান, জেলার চিতলমারী, কচুয়া ও ফকিরহাট উপজেলায় মোট ৯ হাজার বিঘা জমিতে ব্যাণিজ্যিকভাবে টমেটো চাষ করা হয়েছে। বুলবুলের তাণ্ডবে জেলায় ৯০০ বিঘা জমির টমেটো নষ্ট হয়েছে। এছাড়া জেলায় ধানসহ বিভিন্ন ফসলের ২৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষির সংখ্যা এক লাখ ৫৯ হাজার।
সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য এরইমধ্যে সংশ্লিষ্ট উপজেলা পরিষদ থেকে অনুদান পাওয়া গেছে। চাষিদের ওই অনুদান দেয়া হবে। এছাড়া সরকারের কাছে এ এলাকার চাষিদের সাহায্যের জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে, জানান এ উপপরিচালক।